Skip to content

Latest commit

 

History

History
68 lines (37 loc) · 18.4 KB

উল্টালোক-হামীম-কামরুল-হক.md

File metadata and controls

68 lines (37 loc) · 18.4 KB


উল্টালোক

হামীম কামরুল হক



বহুদিন পর ফেসবুকে শ্রেয়সীকে পেয়ে, ওর ইনবক্সে কত বার যে লিখে সেন্ড করতে গিয়ে, বারবার মুছে ফেলেছি কথাটা; ছোট্ট ও অতিসাধারণ কথা—কেমন আছ? লিখতে পারিনি। দিনের পর দিন লিখতে পারিনি। মারাত্মক একটা সংকোচ কাজ করে। বিহ্বল হই। কিছুতেই সংকোচের বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারি না। সেদিন হঠাৎ কী হলো, ছুটির দিন সকালে, লিখলাম, কেমন আছ? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল, ভালো। তুমি কেমন আছ? আমি কিছু লেখার আগেই সে লিখল, ভয় পেয়ো না। তোমার ওপর আমার কোনো রাগ নেই। কনক পুরো বিষয়টা জানে। প্রায় ১২ বছর চলে গেছে। হ্যাঁ, এক যুগ আমি লিখলাম, মার্কিনদেশে ভালোই আছ তাহলে। কয়টা ছেলেমেয়ে? দুটো দেখলাম ছবিতে। সে লেখে, হ্যাঁ, এক ছেলে, এক মেয়ে। আরেকজন আসছে। বাহ! তোমার? একটাই—ছেলে। খুব ভালো। বউ কী করে? কলেজে পড়ায়। বাহ! এরপর অনেকক্ষণ নীরবতা; পরে সে লেখে, এখন উঠব। মেসেঞ্জারে ফোন করব একদিন, কেমন। কথা হবে। বাই। আমি লিখি, বাই।

তখন লেখাপড়া শেষ। একটা ছোট্ট চাকরিও পেয়েছি। ধামরাইয়ের একটা ছোট্ট ক্লিনিকে। দিব্যি ছিলাম। শ্রেয়সী কোনো কোনো ছুটির দিনে সকালে এসে শেষ বিকেলে চলে যায়। সারা দিন আমরা ঘুরে বেড়াই। কখনো চলে যাই আরিচার দিকে; কখনো নবীনগরে এসে চন্দ্রা পার হয়ে মধুপুরে। ওই রকম ছুটির দিন জীবনে আর ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। তখন মাঝে মাঝে রাহুল বৈদ্যর সঙ্গেও দেখা হতো। বিসিএস। তিন বছরের সিনিয়র হলেও বন্ধুর চেয়ে বেশি ছিল সে। কালিদাস আর জয়দেবের মহাভক্ত। আমরা ওকে বলতাম ‘অশ্লীল-বকি’। কবি-র উল্টা ‘বকি’। তখন রাহুল দেখা হলে আর ক্ষীণকটিপীনবক্ষাগুরুনিতম্বিনী–জাতীয় কিছু আওড়াত না, বলত, আবরার, বিসিএসটা দে। পাগলামি করিস না।

দেখতে শুনতে মন্দ ছিলাম না। শ্রেয়সী মাঝে মধে৵ই বলত, ফর্সা সুন্দর ছেলেদের আমার একদম পছন্দ না। তোমার পাল্লায় যে কীভাবে ফেঁসে গেলাম! বলত, ওর কাছে আমার মতো ছেলেদের বরাবরই ক্যাবলা-ভ্যাবলা লাগে। পুরুষ মানুষ হবে: ডার্ক অ্যান্ড হ্যান্ডসাম।

ব্যাংকেও কিছু জমেছিল সেই সাহসেই শ্রেয়সীকে বলেছিলাম, এখন থেকে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি। বলা ছিল: সদরঘাটে ঠিক পাঁচটার সময় থাকব। সে সময় ভাগ্যিস মোবাইল ফোন ছিল না। নইলে আমাকে পাগলের মতো ফোন করত। হয়তো আমি ফোনটা বন্ধ করেই রাখতাম; কিন্তু মনের মধ্যের চাপটা! ভাবা যায়!

এর ভেতরে একটা কথা বলা দরকার, শ্রেয়সী কিন্তু পালিয়ে গিয়ে কিছু করবে না, আমাকে বলেছিল। সে তার বাবাকে বলেটলেই যা করার করবে। তার বাবা কোনোদিন কোনো কাজে বাধা দেননি; এ কাজেও দেবেন না। তার বাবা তাকে বলেছিলেন, যেতে পারিস; কিন্তু আর কোনোদিন কোনো অবস্থায় আমাদের কাছে আসিস না। না, আমি ধরে নেব না তুই মরে গেছিস। ধরে নেব, শ্রেয়সী নামে আমার কোনো মেয়ে ছিল না তো দূরের কথা, আমাদের কোনো মেয়েই ছিল না, জন্মায়ইনি। কথাগুলো শ্রেয়সী আমাকে জানিয়েছিল। ওর মা ততটা অরাজি ছিলেন না। ওর বাবা বাসায় না থাকলে আমি বেশ কয়েকবার ওর মায়ের সঙ্গে দেখাও করেছিলাম। মগবাজারের সোনালীবাগের ছিমছাম বাসাটার সামনে সেদিনও গেলাম। সারা শরীর-মন কেমন যে করে উঠল, বোঝাতে পারব না। যদিও শ্রেয়সীর বাবা–মা–ভাইয়েরা ওই বাসায় আর থাকে না।

আমাদের সম্পর্কটা ছিল একান্ত নিজেদের; নিজেদের বলতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বা ঢাকা মেডিকেল কলেজের আশপাশে, বকশীবাজার-চানখাঁরপুলেও আমরা কোনো দিন একসঙ্গে যাইনি। একমাত্র বইমেলায়, তা–ও দু–একবার গিয়েছি, দূরত্ব বাজায় রেখে চলেছি। দেখে কেউ যেন বলতে না পারে, আমাদের মধ্যে কোনো মাখামাখি–জাতীয় কিছু আছে। আমরা বরং সাভারের দিকে চলে যেতাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রিকশা নিয়ে চক্কর দিয়েছি অনেকবার। ওখানে আমার ও ওর দুজনেরই কারও কোনো চেনাপরিচিতজন ছিল না।

এমনিতে শ্রেয়সীকে নিয়ে কোনোখানে যাওয়ার উপায় আসলে ছিল না। একটু সাজলেই রূপ একদম ফেটে পড়ত। পানপাতার মতো মুখ, কোমরছাপানো দিঘল চুল, দোহারা গড়নের স্বাস্থ্যবতী মেয়ে; লম্বায় প্রায় আমার মাথায় মাথায়। ছায়ানটে রবীন্দ্রসংগীতে পাস করেছিল। রান্নার হাত ছিল অতুলনীয়। কেবল ওর হাঁটাটা কেমন যেন ছিল! এক পা ফেললে মনে হতো, একটু নেমে যাচ্ছে, যেন বসে পড়তে চায়; আরেক পা ফেললে বসতে গিয়ে উঠে আসার মতো ছিল—এ নিয়ে ওকে অনেক খেপিয়েছি, কোনো লাভ হয়নি।

হ্যাঁ, আমরা চিঠি লিখতাম। প্রতিদিন তো আমরা দেখা করতাম না; মাঝে মাঝে। ওই মাঝে মাঝেতে হয়তো আমি আগের চিঠির উত্তর লিখে নিয়ে গেছি, আর শ্রেয়সী নতুন আরেকটা। একটা ছোট্ট নীল খামে ওর চিঠি থাকত। আমি বলতাম, কীসব টিপিক্যাল নীল খামটাম! কোনো মানে আছে! শ্রেয়সী বলত, আছে। ভালোবাসার রং কী জানো?

কী?

নীল।

তাই নাকি!

খুব হেসেছিলাম।

টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনী হাসি দিয়ো না দয়া করে। ভাগ্যিস তোমার হাসিটা অনেক সুন্দর নইলে...

নইলে কী!

শুনে তীব্র ভ্রুকুটি শেষে একটা কটাক্ষ হেনে বলত, তারপর আজকের প্ল্যান কী!

বলধা গার্ডেন।

ওই একবারই গিয়েছিলাম বলধা গার্ডেনে। আর কোনোদিন ওদিকটায় যাওয়া পড়েনি। তা ছাড়া আমি সব সময় চেয়েছি, ঢাকা থেকে দূরে, আরও দূরে, পারলে দেশের প্রান্তে কোথাও চলে যাব। প্রথম দিকে ভেবেছিলাম—একদম স্বাধীন থাকব, কোনো সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করব না। অনেক চিন্তা করে বয়স যখন একেবারে সরকারি চাকরি পাওয়ার শেষ সীমায়, বিসিএসে বসে যাই। পাস করার পর থেকেই আমার চেষ্টা থাকে, ঢাকার বাইরে থাকার। লোকে বলে, আপনি দেখি উল্টালোক। সবাই শহরের দিকে, রবিউল আবরার গ্রামের দিকে!

প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম: বিয়েশাদিও করব না। সে সময় দিনাজপুরের বিরলে একটা চক্ষুক্যাম্পে গিয়ে হঠাৎ পেছন থেকে একজনকে দেখে রীতিমতো ধন্দে পড়ি। ইনফরমেশন ডেস্কে কথা বলছিল। সেই রকম এক বেণি, বেণির প্রান্ত কোমর পার হয়ে দুলছে, পিঠখোলা ব্লাউজ। স্বাস্থ্যে ভরপুর। অপূর্ব শ্রী হাতে-বাহুতে ফুটে বেরোচ্ছে। তিনি যতক্ষণ কথা বলছিলেন, আমি নজর রেখেছিলাম। চলা শুরু করলে পেছন থেকে তার হাঁটার অপূর্ব ছন্দটাই আমাকে বিয়ে নামের মহাকাব্যটা লিখিয়ে নিল।

সব মহাকাব্যের মতো বিয়ের আগের ফাঁদ হলো ‘রূপ’; বিয়ের পরে আত্মরক্ষার জন্য চলে ‘যুদ্ধ’; আর পরিণতি হলো ‘নীরবতা’— আমরা সেই ধারায় যাইনি। আয়েষা শ্রেয়সীর মতো দেখতে অত রূপবতী ছিল না। আদতে তেমন কোনো মিলই ছিল না; কেবল সেদিন কেন পেছন থেকে শ্রেয়সীর মতো লেগেছিল, ওই বেণির জন্য? বা যে শাড়ি ও ব্লাউজ পরেছিল, সেসবে মিলটুকুর জন্যই কি?

বিয়ের পরও আমি প্রায়ই আয়েষাকে অচেনা কোনো মেয়ে দেখার মতো দেখতাম। কেন আমি বিয়ে করলাম, তা–ও আয়েষাকে? এর কোনো ঠিকঠাক জবাবও আমার ছিল না।

আয়েষা আমাকে একদিন মারাত্মকভাবে চমকে দিয়েছিল; বলেছিল, রবি, তুমি কি আমার মধ্যে অন্য কাউকে খোঁজো? হ্যাঁ, তোমাকে আমার তো দেখা শেষ হয় না! তুমি কোনদিক থেকে কী করে এতটা সুন্দর হলে! সেই রহস্য খুঁজি। শুনে আয়েষা বলতে পারত, ঠাট্টা করো, না? কিন্তু বলেনি।

আমাদের মধ্যে ছিল ‘রূপ’ ও ‘নীরবতা’। মাঝখানে ‘যুদ্ধ’টা আমরা করিনি। আয়েষা খুব অল্পকথার স্বল্পভাষী মেয়ে। বিরলের এক সম্ভ্রান্ত বংশের। আমি প্রথম প্রথম বলতাম, বিরলের বিরলতম চিরল কন্যা। বলতে পারিনি, তুমি হে, চারু চুচুম্ব নিতম্ববতী!

আয়েষা জানতে চায়, চিরল মানে কী?

মিহি।

মিহি! আমি তো মোটা।

দুরো কীসের মোটা! এদেশে কেউ স্বাস্থ্যভালোকে বলে মোটা, তুমি একদম ঠিক আছ, আর তোমার কথা তো মিহি। তুমি খুব নরম করে কথা বলো।

শ্রেয়সীর কণ্ঠ মিহি ছিল না। ছিল হাস্কি। অমন হাস্কি গলায় যখন রবীন্দ্রসংগীত গাইত, একদমই বোঝা যেত না। শ্রেয়সী অনেক কিছুই বলার আগেই বুঝত। ওর বাবার কথাগুলো আমাকে না বললে আমি হয়তো সেদিন সদরঘাটে যেতাম। ওকে নিয়ে বরিশালে চলে যেতাম। সেখানে ও একটা গানের স্কুল চালাবে, আমি নিজের চেম্বার খুলব।

এখন আমাদের ভেতরে সাতসমুদ্দুর তেরো নদীর ব্যবধান। পুরোনো বন্ধুদের ভেতর রাহুলের সঙ্গেই যোগাযোগটা আছে। রাহুল বৈদ্য তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ফেসবুকটা খুলিয়েছে; না খুললে আমি কি শ্রেয়সীর খোঁজ করতাম? ওর বরের পদবিও এক: চক্রবর্তী। কনকও ছায়ানটে যেত নজরুল শিখতে। তরুণ স্থপতি হিসেবে তখনই নাম করেছিল। বৃত্তির জন্য চেষ্টা করছিল। বিয়েতে নিশ্চয়ই শ্রেয়সীর বাবার বিরাট আশীর্বাদ ছিল। বিয়ের পরপরই কনক ফুলব্রাইট বৃত্তিটা পায়; পেয়েই আমেরিকায়। অল্প কদিনের ভেতরে শ্রেয়সীও। এখন মার্কিনদেশেই থিতু।

একটা বিষয় কোনোদিন মুছে দিতে পারিনি। সদরঘাটে শ্রেয়সীর সেই অনড় অচল অপেক্ষার পর আমার না যাওয়া এবং ওর বাড়ি ফিরে আসা, দরজা খুলে ওর বাবা যে ওর মুখটা দেখেছিলেন, সেই মুখটা তো আমি কোনো দিন দেখিনি; অথচ কল্পনায় বারবার সেই মুখটাই বহু দিন ফিরে ফিরে আসত।

শ্রেয়সী আমাকে ক্ষমা করেছে! জগতে এর চেয়ে শান্তিদায়িনী কথা আর কী হতে পরে! এটুকু জানতেই অপেক্ষা ছিল। আর কোনো পিছুটান নেই। শ্রেয়সীর সঙ্গে আর কোনোভাবেই যাতে যোগাযোগ না হয়, সে জন্য আমি ফেসবুক ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিই।