খুনখারাবির গল্প লিখতে চাই না আমি।
কী দরকার বলেন? ওসব গল্পে চটতে পারে কেউ কেউ। বাক্স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে কোনো লাভ হবে না তখন। আর গল্প তো কবিতার মতো ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে লেখা যায় না।হয়তো অস্পষ্ট গল্প আছে কিছু, কিন্তু আমি তো স্পষ্ট গল্পই লিখি। এত ট্রান্সপারেন্ট হতে গিয়ে কবিতা লেখা হয়নি আমার। কবিতা বেশি স্পষ্ট হলে স্বীকারোক্তির মতো শোনায়। কিন্তু গল্প স্পষ্ট হলে ঝামেলা নেই তেমন, ফুল-পাখি, প্রেম-ভালোবাসা হলে স্পষ্টত্ব দোষের কিছু না। কিন্তু খুনখারাবির গল্প হলে অনেক দূর দিয়ে হাঁটতে হয়, পোষায় না আমার।
খুনখারাবির গল্প না, আসলে আমি কোনো গল্পই লিখতে চাইনি। যত দিন একটা চাকরি ছিল, তত দিন না লেখার জন্য আর কোনো অজুহাতের দরকার পড়েনি। এই ঢাকা শহরে একটা সকাল-সন্ধ্যার চাকরি যাকে করতে হয়, তাকে অন্য যেকোনো কিছু না করার জন্যই দোষ দেওয়া যায় না। তাকে সংসার না করার জন্য, মা–বাবা না হওয়ার জন্য বা কবি-লেখক না হওয়ার জন্য কোনো দোষ দেওয়া যায় না। আমিও চল্লিশ বছর লিখিনি কিছুই। ঢাকার লেগুনা, মুড়ির টিন বাস, খাবলা খাবলা ভাঙা রাস্তার রিকশা করে, কণ্টকাসনের মতো বদসুরত চাকরি করে করে কেটে গেছে বছরের পর বছর। তারপর একদিন আমার মনে হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে। ছেড়ে দিয়েছি চাকরি। দিনে একবেলা খাওয়ার মতো ব্যবস্থা আছে। আর বাকি সব বাদ। তখনই আসলে মনে হয়েছে, না লেখার কোনো অজুহাত নেই আর।
লিখতে গিয়ে যে গল্পগুলো এসে যাচ্ছিল, সেগুলো এড়ানোর জন্য প্রথমে কিছুদিন ধুমসে প্রেমের গল্প লিখেছি। কিন্তু আপনারা তো জানেনই, প্রেমের চেয়ে ক্ষণস্থায়ী জগতে আর কিছু নেই। ফলে প্রেমের গল্পও টেকেনি। এবার আমাকে সেই গল্পগুলোর মুখোমুখি দাঁড়াতেই হচ্ছে, যেগুলো লিখতে চাই না। যেমন সাত দিন আগে যখন বৃষ্টি নামল খুব, আমার মাথায় ঘুর ঘুর করতে শুরু করল একটা খুনের গল্প। এক পুঁটলি নাইলনের সুতা পকেটে নিয়ে একটা চৌদ্দ তলা বিল্ডিংয়ের গেটে দারোয়ানের হাজিরা খাতায় ভুল নাম লিখে লিফট দিয়ে বারো তলায় উঠে গিয়ে নাইলনের সুতা গলায় পেঁচিয়ে একজনকে মেরে ফেলা! হাজিরা খাতায় খুনি কী নাম লিখবে, সেটা পর্যন্ত মাথায় ঘুরতে শুরু করল—কণিকা! যাকে মারব, তার নামও আমার ডাইনে–বাঁয়ে ছোটাছুটি শুরু করল—ফয়সল আহমেদ! বোঝেন অবস্থা! ফয়সল নামের কাউকেই চিনি না আমি। সে আবার বিদেশে থাকে, অল্প কিছুদিনের জন্য ঢাকায় এসেছে। তবে খুনটা কেন, সেটা মাথায় আসার আগেই গল্পটা আটকে দিতে পারলাম। কে খুন করবে, কাকে করবে, সেটার চেয়ে কেন খুন করবে, সেটা জটিল নয়? আবার খালি খুন ঘটিয়ে দিলেই তো হয় না, তারও তো পর থাকে। যদিও সব খুনের পর থাকে না, কিছু কিছু খুন, খুনেই শেষ হয়। কিন্তু গল্পের খুন, খুনেই শেষ করে দিলে আপনারাই বলবেন, আজগুবি। গল্পের খুনটা কেন, সেই জটিলতার মীমাংসা হলো না বলে খানিক উপকার হলো আমার। লিখে ফেললে, কে জানে, কোন খুনি আইডিয়া চুরি করে ফেলত, তখন খুঁজতে খুঁজতে আমার নাম বেরিয়ে পড়ত। আমার খুব হালকা লাগতে লাগল। টেলিগ্রাম সাইজের কয়েকটা কবিতাও লিখে ফেললাম। সেসব কবিতায় আবার প্রেম আসতে শুরু করল, ফেসবুকে সেসব পোস্ট করলে বন্ধু–বান্ধব মৃদু আশকারা দিল। ফলে কয়েক দিন ভালো ঘুম হলো।
এমন না যে আমি খুব থ্রিলারট্রিলার পড়ি, কিন্তু একদম অকারণে কারও মাথায় খুনের গল্প তো আসতে পারে না। তাও এই রকম আনস্মার্ট খুন, নাইলনের সুতা গলায় পেঁচিয়ে! ২০২০ সাল চলছে, অত্যাধুনিক সব কাজ কারবার এখন। কিন্তু আজকাল আধুনিক বহুতল বাসাগুলোর দৈত্যাকৃতির ফটকে মেটাল ডিক্টেটর থাকে। পকেটে করে সাইলেন্সার পিস্তল নিয়ে ঢুকলেও ওটা টিকটিক করে চ্যাঁচাবে না? ফলে, ওটাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য বিকল্প খুঁজতে খুঁজতে এক বাসায় দাওয়াত খেতে গেলাম। বিয়ে-জন্মদিন না, সাধারণ দাওয়াত, কয়েকজন বন্ধু মিলে পানাহার আর আড্ডা। আমি অত আড্ডাবাজ নই, তার ওপরে চা-কফি ছাড়া পানটানেরও অভ্যাস নেই তেমন। তারপরও ওই আড্ডায় গেলাম, কারণ ওটা কবিদের আড্ডা ছিল। আমি ভেবেছিলাম কবিদের আড্ডায় গেলে নমনীয়-কমনীয় কথাবার্তা শুনে আমার মাথা থেকে খুনের গল্প বিদায় হয়ে যাবে। সে আড্ডায় আরও চারজন ছিল, আমি ছাড়া বাকিরা সবাই কবি। আরও একজনের আসার কথা ছিল, তিনি কবি নন, কিন্তু আমি তাঁর বোকা বোকা কথার প্রেমে পড়েছিলাম। চার কবি আর দুই অকবি মিলে দারুণ ককটেল হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু তিনি আসেননি। ফলে, অ্যালকোহলে সোডা কম হওয়ার মতো আড্ডা হলো। খাব না খাব না করেও দু–তিন পেগ খেয়ে ফেললাম। কবিদের একজন নিজের কবিতা পড়ে শোনালেন, তারপর একসময় দেখি আড্ডা চলে গেছে হেমলক বিষে। সেখান থেকে আড্ডা ঘুরে গেল নান্দনিক খুনের দিকে, যেমন একজন বলল, বরফের ছুরি গলায় ঢুকিয়ে দিলে ওটা আর বেরও করতে হয় না, গলে যায়। আমার মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় একটা ডিটেকটিভ বই পড়েছিলাম, সেখানে এ রকম একটা খুনের কাহিনি ছিল, গোয়েন্দারা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না, খুনটা কী দিয়ে করা হয়েছে। কোনো অস্ত্রপাতির দাগ নেই শরীরে। চার কবি মিলে একের পর এক খুনের গল্প করতে শুরু করল। আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলাম, আমার মাথায়ও একটা খুনের গল্প ঘুরছে! কিন্তু এই বলে ফেলাও আটকে দিতে পারলাম। আর অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, এই কবিরা সবাই খুন হয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকে। এরা রাতবিরাতে একা চলতে ভয় পায়। কবিদের মধ্যে যে ব্যাচেলর, সে নিজের বাসায়ও একা থাকতে ভয় পায়। পাশে লাঠি নিয়ে আলো জ্বেলে ঘুমায়। অথচ এরা কেউ বিদ্রোহী কবিতা লেখে না। প্রেমট্রেম নিয়েই লেখে বেশি। খুব বেশি হলে যানজট বা বায়ুদূষণ। একজন আবার সুন্দরবন নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেসবুকে দিয়ে দুই মিনিট পরে সরিয়ে নিয়েছে। তবু খুন হয়ে যাওয়ার ভয়ে কাঁপে এরা। আর এতক্ষণ পরে আসলে আমি বুঝতে পারি, এদের খুনের গল্প খুন করার নয়, হওয়ার।
এমন না যে আমি খুব থ্রিলারট্রিলার পড়ি, কিন্তু একদম অকারণে কারও মাথায় খুনের গল্প তো আসতে পারে না। তাও এই রকম আনস্মার্ট খুন, নাইলনের সুতা গলায় পেঁচিয়ে!
আড্ডা থেকে বেরিয়ে বাসার দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমার খুনের গল্প বদলে গেল। একটা খুন ঘটিয়ে দেওয়ার বদলে আমার মাথায় ঘুরতে লাগল, আমিই খুন হয়ে যাই না কেন! কাউকে খুন করতে পাঠাতে হলে দুইটা চরিত্রের মনস্তত্ত্ব ডিল করতে হবে। কিন্তু যদি আমিই খুন হই, তাহলে শুধু খুনিরটা ডিল করলেই হয়। গল্প লেখা অর্ধেক সহজ হয়ে যায়। যে খুন হয়, তার তো তেমন ঝামেলা নেই, শুধু হয়ে যাবে। যে খুন করবে যাবতীয় ঝামেলা তার। আমাকে কে কে খুন করতে পারে, তার একটা শর্ট লিস্ট করা যেতে পারে। প্রথমেই মনে পড়ল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হীরার কথা। হীরার কথা কেন মনে হলো! চমকে উঠে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালাম। এগারোটা বাজে, তবু পান্থপথের যেখানে মিরপুর রোড মোহনা সেখানে দাঁড়িয়ে গেছে আমার রিকশা। আমি দুদিকে মাথা ঝাঁকিয়েছি বলে রিকশা থেমে গেছে, তা নয়। জ্যামটা আমার মাথা ঝাঁকানোর জন্য লাগেনি। আমার রিকশার আশপাশে আরও রিকশা প্যাসেঞ্জারসমেত বা খালি দাঁড়িয়ে আছে। আমার সন্দেহ হয়, শুধু মাথাই ঝাঁকিয়েছি, নাকি মুখে কিছু বলেছিও? পাশের রিকশার লোকটা ওভাবে তাকিয়ে আছে কেন? কী অদ্ভুত অবস্থা! এইগল্প ডোবাবে আমাকে। রাত এগারোটায় ঢাকার রাস্তায় আমার মাথায় খুনের গল্প, এটা জানলেও তো আমাকে ধরে নিয়ে যাবে পুলিশ। কানে হেডফোন দিয়ে তাই শচীন কর্তার সঙ্গে 'শোনো গো দক্ষিণও হাওয়া'র শিস বাজাতে বাজাতে বাসায় ফিরলাম। ভাবলাম, খুনের গল্প কুলি করে ফেলে দিয়ে ঘুমিয়ে যাব। পেটে মদ নিয়ে খুনের গল্প লিখতে বসা মোটেই ঠিক হবে না। আর বিলক্ষণ মনে হলো, ব্যাটা তিন পেগের জন্যই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর নাম এক নম্বরে চলে আসতে পেরেছে। কিন্তু ঘুম এল না, ঘণ্টা খানেক পরে মাসিপিসি বিদায় হয়ে গেল। কম্পিউটার খুলে ঘোরগ্রস্তের মতো লিখতে বসলাম। আর অবাক হয়ে দেখলাম হীরাই এসে যাচ্ছে। হীরা আমাকে কেন খুন করবে, আশ্চর্য! হীরা তো তেমন ছেলে নয়। হীরা ওর যাবতীয় কথা আমাকে বলে। ছোটবেলা থেকে বন্ধু আমরা। খুব গল্প করতে ভালোবাসে। আর সত্যি গল্পের মধ্যে মিশিয়ে দেয় মিথ্যা গল্প। ঠিক মিথ্যা নয়, বানানো। ওর গল্পের বানানো অংশ ধরতে পারি আমি। এমনকি ও যখন ফোনেও কথা বলে, তখনো ওর গলার স্বর বদলে গেলে বুঝতে পারি এবার গল্পে ঢুকে গেল, বানানো অংশ। এই যেমন, হীরা যখন একদিন বলল, ওর বউ ওকে কষ্ট দেয়, সারা রাত ওর বুকে অথবা বাহুতে মাথা রেখে ঘুমায়, সকালে উঠে ও দেখে পাঁজরের হাড় আর কাঁধের জোড়ায় ভীষণ ব্যথা। তখন আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ওর বউ দূরে সরে ঘুমায়, আর ও চায় বউ তাঁর বুকে বা বাহুতে মাথা রেখে ঘুমাক। যখন আমি বললাম, আমি ভাবিকে বলব যেন তোর বুকে না ঘুমায়? হীরা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বলল, 'তোকে খুন করে ফেলব।' এ রকম আরও অনেকবার হীরা আমাকে খুন করতে চেয়েছে। অফিসের ফান্ড থেকে যেবার ১০ লাখ টাকা সরাল, সরিয়ে চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারে না। আমি বললাম, 'হজম না করতে পারলে ফেরত দে। তুই না পারলে আমাকে বল, আমি ব্যবস্থা করব।' সেদিনও বলেছিলিয়া একটা কথা যদি কাউকে বলিস, খুন করে ফেলব তোকে।' পলিটিক্যাল কী কী সব গ্যাঞ্জামও আছে ওর, বলেছে আমাকে সব, ভুলেও গেছি কিছু কিছু। এত কথা বলে যে, আমার মাথা অটো সেন্সর বসিয়ে, পছন্দমতো তথ্য বাছাই করে বাকিগুলো ফেলে দিয়েছে। হীরা অনেক অনেক গোপন কথা আমাকে বলে ফেলেছে বলে, কথাদের নিরাপত্তার জন্য খুন করে ফেলতে পারে আমাকে? যদি করে তাহলে কী দিয়ে করবে? গুলি করবে? নাহ মনে হয়। ওর বাসায় অনেক যাই আমি, গেলে বউ আর ও মিলে খুব রান্নাবান্না করে। এমনকি হতে পারে, কোনো একটা খাবারে বিষ মিশিয়ে দিল? সেটাও তো করতে হবে বউকে না জানিয়ে, বউ জানলে আবার তো ওর গোপন কথা অনিরাপদ হয়ে যাবে। বিষ মেশানো খাবার খেয়ে আমি যখন ঝটপট করব, তখন কি হীরার মনে পড়বে, ও যখন লিভার সিরোসিস হয়ে মরতে বসেছিল, তখন দিনরাত একাকার করে আমি ওর পাশে থেকেছি, ছোটাছুটি করে ধারদেনায় ডুবে হাসপাতালের বিল দিয়েছি? সত্যি বলতে কি, আমার এখন দেখতে ইচ্ছা করছে যে তখন হীরা কী করে। বিষ মেশানো খাবার খেলে সঙ্গে সঙ্গে তো মরে যাব না মনে হয়, দেখার সময় পাওয়া যাবে। খুনিদের লিস্ট বানাব ভেবেছিলাম, হীরা ছাড়া আর যাদের নাম মনে আসছে, তাদের নিয়েও চমকে গেলাম। কি অদ্ভুত! খুনের গল্প মাথায় না এলে কখনো কি এসব ভাবতাম! বিপজ্জনক কিছু বন্ধু বান্ধব আছে আমার, এটা সত্যি। তবে ওদের গোপন খবর জানা ছাড়া আর কোনো ঝামেলা নেই আমার। কী জানি, গল্প লেখার বাতিক আছে বলেই কিনা ওরা আমাকে এত কথা বলে ফেলে। হয়তো প্লট সাপ্লাই দেয়। কিন্তু জমা রাখা গোপন কথা নিয়ে বেইমানি করি না আমি। গল্পেও কখনো আনি না। কিন্তু ওদের কেউ ধরা পড়লে খুঁজতে খুঁজতে আমি পর্যন্ত এসে যেতে পারে গোয়েন্দা বা পুলিশ বা গ্যাংস্টারদের কেউ। তখন রিমান্ড বা আজাবের ভয়ে বলে ফেলতে পারি অতি সাবধানে জমিয়ে রাখা বন্ধুদের প্রাণ-সংহারী কথা। সে কারণেই ওরা আমাকে খুন করে ফেলতে পারে। হীরার পরে যে নামটা মাথায় এল, সেটাতেও চমকালাম। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালোই। বিপদের সময় তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করি। যদিও তাদের প্রায়ই মনে হয়, আমি অনেকটা রোবোটের মতো। তাদের জন্য দুশ্চিন্তা করি না, শুধু হাজির থাকি। আমার ফুফুর নাম চলে এল দুই নম্বরে। আমার এই ফুফু দুনিয়ার সব বিষয় ও ব্যক্তি নিয়ে বিরক্ত। তার বিরক্তি প্রায়ই রাগে উঠে যায়। সে হিসাবে আমার ওপরও আছে হয়তো। শুধু এই কারণে সে আমাকে খুন করে ফেলবে, তা তো হতে পারে না। অনেক চিন্তা করে দেখলাম, এখানেও গোপন কথারই ব্যাপার। ফুফুর একটা পরকীয়া প্রেম আছে, সেটা সে ভুল করে আমাকে একদিন বলে ফেলেছিল। বলে ফেলার পর থেকে তার হয়তো একটা ইরেজারের জন্য আফসোস হয়, আমার মাথার কাগজে, তার পেনসিল-প্রেম, ইরেজারে ঘষে তুলে ফেলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু তবুও তো আমাকে খুব করে ফেলার মতো কারণ তৈরি হয় না। এমনকি হতে পারে ফুফু, ফুফাকে বা তার প্রেমিককে, যেকোনো একজনকে মেরে ফেলে শান্তির জীবনে ফিরে যাওয়ার প্ল্যান করছে? আর যেহেতু আমিই একমাত্র তার এই জটিলতা জানি, ফলে আমাকেও খুন করে ফেললে তার আর চিন্তার কিছু থাকে না। এটা হতে পারে। আর আমি নিশ্চিত জানি, ফুফু যদি আমাকে খুন করে, তাহলে উঁচু কোথাও নিয়ে গিয়ে, ছোটবেলার গল্প করতে করতে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেবে। নিচে যদি পানি থাকে, তাহলে কষ্ট কম হবে তার। মানে এটা কোনো উঁচু রেলব্রিজ হতে পারে। হয়তো কালকেই ফুফু বলবে, 'চল রে ঝিনুক মা, কোথাও থেকে দুই দিন বেড়ায়া আসি।' আমি পরিষ্কার বুঝতে পারব, ফুফু আমাকে খুন করতে নিয়ে যাচ্ছে, তবু যাব। আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করবে, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার সময় তার মুখটা কেমন দেখায়। ফুফুর পরে দেখি লাইনে দাঁড়িয়ে আছে আমার সাবেক প্রেমিক জয়ন্ত। হায় জয়ন্ত, এভাবে ফিরে আসবে তুমি, ভাবিনি আমি! আমার খুনি হিসেবে আসতে হলো তোমাকে! জয়ন্তকে একটা সময় পর্যন্ত খুব ভালোবাসতাম আমি। জয়ন্ত আমাকে না বলার মতো করে সব কথা বলত। যখন বলত, তখন এত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলত যে কোনটা অতিরঞ্জিত আর কোনটা সাদামাটা কথা বোঝা যেত না। এমনকি কোনটা ব্যক্তিগত, কোনটা গোপন আর কোনটা একেবারে জেনারেল কথা তাও আলাদা করতে পারতাম না। এখানেও দেখেন শ্রোতাই আমি। আমার কাজ কেবল লোকেদের কথা শুনে যাওয়া। আর অনেক কথা শুনে ফেললে, তাতে গোপন কথা তো থাকেই। কিন্তু জয়ন্তর বেলায় অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটেছিল। ওর কথা শুনতে শুনতে এক সময় হঠাৎ করে আমি ওকে পুরোপুরি বুঝে ফেললাম। কী বলছে, কেন বলছে, কী করছে, কেন করছে—সব। ফলে, আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। সেটা ওকে বলতে পারিনি কিছুদিন, নানা ভাবে এড়াচ্ছিলাম। প্রথমে কিছুদিন হয়তো খেয়াল করেনি। যখন বুঝল খুব রেগে গেল। বারবার জানতে চাইল, কী হয়েছে? কিন্তু এটা কীভাবে বলা যায় যে তোমাকে সহজ একটা বইয়ের মতো পড়তে পারছি আমি! তাই বলে প্রেম ভেঙে দেওয়ায় সে আমাকে খুন করে ফেলবে? এত দিন পরেও কি তার অপমান বোধ কাটেনি? নাকি অনেক গোপন কথা আমার কাছে রয়ে গেছে বলে শান্তি পায় না সে? জয়ন্ত আমাকে খুন করলে কীভাবে করবে, গলা টিপে? আমি সত্যি ফিল করলাম, আমার গলায় বসে গেছে দশটা শক্ত আঙুল! বড় বড় চোখ করে আমি তাকিয়ে আছি জয়ন্তর দিকে। আমার কি একবার খারাপ লাগবে, জয়ন্তকে ছেড়ে দিয়েছি বলে? সে কি অনেক কষ্ট পেয়েছিল, আমি আর তাকে ভালোবাসিনি বলে? তিন খুনির কথা লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে ল্যাপটপ ভাঁজ না করেই ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুমের মধ্যেই শুনতে পেলাম কী যেন একটা ধাম করে পড়ল, কিন্তু আমার তিন পেগ আর তিন খুন মিলে ঘুমটাকে একেবারে গাঢ় করে ফেলেছে, তলিয়ে গেলাম। ঘুম যখন ভাঙল, বুঝতে পারলাম না সকাল না দুপুর। বিছানা থেকে মেঝেতে পা নামাতে গিয়ে দেখি ল্যাপটপটা চার টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। তার পাশেই কয়েক টুকরো হয়ে রক্তে ভেসে পড়ে আছি আমি।
অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]