Skip to content

Latest commit

 

History

History
98 lines (52 loc) · 10.4 KB

চোখে-চোখে-হুমায়ূন-শফিক.md

File metadata and controls

98 lines (52 loc) · 10.4 KB


চোখে চোখে

হুমায়ূন শফিক



মূলত রক্ত বিক্রি করি আমি। রক্ত বিক্রি করে যে সংসার চালাই তা কিন্তু নয়, এটা ধরতে পারেন নেশা। লকডাউন আর বাংলাদেশে নেই। মাস্ক ছাড়াই ঘুরি-ফিরি।

একদিন সকালে একটা ফোন আসে। ফেসবুকে নম্বর দিয়ে রেখেছি, বলেছি—রক্তের প্রয়োজনে ফোন দেন—০১৬৮৪৩২…. । ওপাশ থেকে কেউ একজন বলল, নাফিস বলছেন?

জি বলুন।

ফেসবুক থেকে নম্বরটা পেয়েছি। রক্তের জন্য। আপনার গ্রুপ তো ও পজিটিভ।

হ্যাঁ।

আজ কি রক্ত দিতে পারবেন?

হ্যাঁ, রক্ত দেওয়ার সময় আবার হয়েছে। কোথায় আসব?

ক্লিনিকের নাম বলল। সেই ক্লিনিকের নাম অবশ্য শুনিনি। কারণ ঢাকার মধ্যে প্রায় সব হাসপাতাল বা ক্লিনিকে আমি গিয়েছি রক্ত দিতে।

ক্লিনিকটা ছিল ধানমন্ডিতে। সাত নম্বর রোডে। মাস্ক পরে সেই ক্লিনিকের সামনে দাঁড়িয়ে ফোন দিলাম। ওপাশ থেকে বলল, তিনতলায় চলে আসেন।

তবে বিল্ডিংয়ের দারোয়ান বাধা দিল। বলল, কই যাইবেন স্যার?

তিনতলায়। ক্লিনিকের নাম বললাম।

অহ, রক্ত দিতে আইছেন। যান যান।

লিফট থাকা সত্ত্বেও সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম তিনতলায়। কলিংবেল টিপতেই মাস্ক পরা এক নারী দরজা খুলে অভ্যর্থনা জানাল।

রুমে বসে আছি। জুতার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। খটখট, খটখট। মৃদু শব্দে এই রুমের দিকে এগিয়ে আসছে কেউ। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে এক মেয়ে খানিক হাসল, ভালো আছেন?

ভালো। আপনিই ফোন দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। আপনি আমাকে বাঁচালেন। অনেক ধন্যবাদ।

মেয়েটির মুখ দেখতে পারছিলাম না। কিন্তু চোখ দেখেই বুঝেছিলাম, মেয়েটি খুবই সুন্দরী। দুই সেকেন্ডের জন্য তার চোখ নিয়ে স্বপ্ন দেখে ফেললাম। মাস্ক পরা কোনো মেয়ের সাথে প্রেম করছি। আমাকে সারা জীবন সে পাশে থাকতে বলছে। সুন্দরী মেয়ে যেহেতু, তার কথা ফেলে তো দিতে পারি না।

আমিও মাস্ক পরা। চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কোনো সমস্যা হচ্ছে?

স্বপ্ন থেকে ফিরে এসে বললাম, না।

মেয়েটি মৃদু হাসল। মাস্ক পরা সত্ত্বেও তার হাসিটা আমি দেখতে পেলাম। মনে মনে ছবি আঁকলাম একটা—এই মেয়ের সাথে চুটিয়ে প্রেম করার ছবি। প্রতিদিন কথাবার্তা হচ্ছে, মাঝেমধ্যে ঘুরতেও যাচ্ছি। মনে হচ্ছে, যেন কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচব না। রিকশায় ঘুরলামও। একটা চিপায় গিয়ে চুমু খাব, এমন সময় বিস্ময়দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের ঠোঁট নেই!

আপনি সুস্থ তো? মেয়েটি আবারও একই প্রশ্ন করল। যেমনই লাগুক সুন্দরী মেয়েরা ‘সুস্থ তো’ জিজ্ঞেস করলে কখনোই বলা যাবে না যে অসুস্থ বোধ করছি।

হ্যাঁ। সুস্থই তো। বলতে বলতেই একজন নার্স ভেতরে আসল। শুয়ে পড়তে বলল আমাকে।

বাধ্য ছেলের মতো শুয়ে পড়লাম। এক ব্যাগ রক্ত নেবে। মাস্ক পরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি, শরীর থেকে সব রক্ত নিয়ে গেলেও বোধ হয় টের পাব না। রক্ত নেওয়া শেষ হলে আমাকে বিভিন্ন ধরনের ফলের জুস দেওয়া হলো। তখন মেয়েটি বলল, আমার তো প্রায়ই রক্ত লাগে। আপনি যদি আবার দেন, তাহলে খুশি হব। সঙ্গে সঙ্গেই আমি রাজি।

নিচে নামার সময় মেয়েটির চোখের কথা মনে হচ্ছিল বারবার। জানি না কী মায়া রয়েছে ওই দুটো চোখে। বাসায় পৌঁছেও ভুলতে পারলাম না। আবার স্বপ্ন দেখলাম, তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আহা, কী মধুর সেই স্বপ্ন!

এক সপ্তাহ পরই সেই নম্বরে ফোন দিলাম, আবার কবে রক্ত লাগবে?

আজও লাগবে।

আসছি। ওয়েট।

মেয়েটিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বের হলাম।

তিনতলায় উঠেই কলিংবেল চেপে একটু অপেক্ষা করতেই নার্স এসে দরজা খুলে দিল।

রুমে বসে আছি। মেয়েটির হাঁটার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসি দিল বুঝলাম।

আপনার রক্ত আর নেওয়া যাবে না। পরে অসুস্থ হয়ে যাবেন।

কিছুই হবে না।

না। জেদ করছেন কেন?

জেদ না।

সত্যি বলতে, আমার প্রতিদিন রক্ত লাগে। আপনারা অসুস্থ হয়ে গেলে রক্ত কে দেবে?

আচ্ছা, প্রতিদিন রক্ত লাগার কারণ জানতে পারি?

মেয়েটি আবারও হাসল। একটু বেশিক্ষণ ধরেই হাসল। মাস্ক পরা অবস্থায়ও কেউ যে এত কলকলিয়ে হাসতে পারে, তা আমার জানা ছিল না।

আসলে আপনাকে বলা উচিত হবে না।

আরে বলেন!

আসলে আমার ব্লাড ক্যানসার।

মাস্ক খুলে ফেলল মেয়েটি। আমি চমকে উঠলাম। কেউ এত সুন্দর হতে পারে, ভাবতেও পারি না। চোখ দুটো এত সুন্দর কেন?

কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কী নির্মম পরিহাস! এমন একটি মেয়েকে এত বড় একটি রোগ দিয়েছেন। কেন ভাই, মেয়েটি সুস্থ থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো!

সেদিন রক্ত দিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামছিলাম আর কেঁপে উঠছিলাম, জানি না কেন কাঁপছিলাম। কল্পনায় ভেসে উঠছিল মেয়েটির মরা মুখ।

এ রকম কেন হলো? এত দিন পর একজনের প্রেমে পড়লাম, তার কিনা ব্লাড ক্যানসার!

কিছুদিন পরপর মেয়েটিকে আমি দেখতে যেতাম, আর ব্লাড দিয়ে আসতাম। তার নামও জানা হয়নি। হুট করেই একদিন সেই মেয়ে ফোন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তারপরও একদিন সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটির খোঁজ দিতে পারেনি কেউই। কোথায় গেছে, কেমন আছে—কেউ জানে না। তার ফোনটাও অফ। এখনো সেই মুখ দেখার জন্য রাস্তাঘাটে পাগলের মতো চেয়ে থাকি, সেই চোখ দুটো দেখার অপেক্ষায়।